হার্ট এর লক্ষন, প্রতিকার ও জটিলতা,Heart's symptoms, remedies and complications
হার্ট এর লক্ষন, প্রতিকার ও জটিলতাHeart's symptoms, remedies and complications
হঠাৎ হার্ট এর জটিলতাঃ
আমাদের বুকের ভেতর হৃদ্যন্ত্র প্রতি মুহূর্তে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন করে দেহকে সচল রেখেছে। হৃৎপিণ্ডের ভেতরে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রক্তনালিতে প্রবহমান রক্ত কার্যত হার্ট ও প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখে। হার্ট হলো আসলে একটি পাম্প, যা প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ বার হার্টবিট তৈরি করে বা হৃৎস্পন্দন তৈরি করে রক্তের প্রবাহকে সচল রাখে। এই হৃৎস্পন্দন তৈরিতে বা প্রবাহে কোনো গোলমাল হলে তাই আমাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই পরিস্থিতির নাম অ্যারিদমিয়া।
হৃদ্রোগ এখনো মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বয়স, লিঙ্গ, জাতিসত্তা, পারিবারিক ইতিহাস হৃদ্রোগের অপরিবর্তনীয় ঝুঁকি। ধূমপান, উচ্চরক্তচাপ, রক্তে অধিক কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, মেনোপোজ, স্থূলতা, মানসিক চাপ, কায়িক শ্রমহীনতার মতো ঝুঁকি চাইলেই আমরা কমাতে পারি। হার্ট অ্যাটাক ও অ্যারিদমিয়ার কারণে মৃত্যু হয় বেশি। করোনারি আর্টারিতে চর্বির আস্তরণ পড়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সময়মতো আধুনিক চিকিৎসা বা রিপাফিউশনের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়া ধমনিতে রক্ত চলাচল পুনরায় চালু করতে না পারলে ৩০ মিনিটের মধ্যে হার্টের মাংসে পচন শুরু হয় এবং ছয় ঘণ্টায় গভীর পচন হতে পারে। রোগীর উপসর্গ শুরু হওয়ার দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে এই রিপাফিউশন করতে পারলে সর্বোচ্চ উপকার পাওয়া যায় ও হার্টকে বাঁচানো সম্ভব হয়। হার্ট অ্যাটাকের সময় প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে করোনারি আর্টারিতে জমাট বাঁধা রক্ত দ্রুত অপসারণ করাই এ রোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা। ক্ষেত্রবিশেষ ফিব্রিনোলাইটিক্স ও অন্যান্য ওষুধ দিয়েও হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
হৃদ্যন্ত্রের দ্বিতীয় বড় ঘাতকের নাম অ্যারিদমিয়া। হৃৎপিণ্ডে তৈরি হওয়া স্বাভাবিক বিদ্যুৎ তরঙ্গের কোনো অনিয়ম ঘটলে অ্যারিদমিয়া হয়। হঠাৎ হৃদ্রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ এই অ্যারিদমিয়া। অনেক ক্ষেত্রেই অ্যারিদমিয়ার কারণ জানা যায় না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যারিদমিয়ার কারণ হলো হৃদ্রোগ, মানসিক চাপ, ক্যাফেইন, তামাক, অ্যালকোহল, খাওয়ার বড়ি ইত্যাদি। স্বল্প মাত্রার অ্যারিদমিয়ার চিকিৎসা লাগে না। আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে অ্যারিদমিয়ায় আকস্মিক মৃত্যু অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব।
সুস্থ–সবলভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেউ, কোনো সমস্যা নেই, একদিন হঠাৎ শোনা যায় তাঁর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’ হয়ে গেছে। সমস্যা হলো এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে প্রায়ই কিছু জানা যায় না। এ রকম হার্ট অ্যাটাকের পরিণতি হয় সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু, নয়তো জীবনের সঙ্গে আপস করে কোনোমতে চলা। তাই হৃদ্রোগ হওয়ার আগেই সাবধান হতে হবে।
কীভাবে বুঝবেন ঝুঁকিতে আছেন?
কোনো সমস্যা বোধ করছেন না, বুকে ব্যথা করে না কখনো, অনেক পরিশ্রমও করতে পারেন, তার মানে কোনো দিন হার্ট অ্যাটাক হবে না—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে ঝুঁকি কতটুকু আছে, তা জেনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে অকালমৃত্যু বা কঠিন পরিণতি এড়ানো যায়।
নিজের ঝুঁকি জানতে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে আপনি আপনার ঝুঁকির মাত্রা জানতে পারেন। প্রশ্নের বেশির ভাগ উত্তরই যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তবে আপনার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বেশি
আপনি কি ধূমপান করেন?
আপনার পরিবারে কি হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস বা অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর ইতিহাস আছে?
আপনার কি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি আছে?
আপনি কি কায়িক শ্রমবিহীন জীবন যাপন করেন? আপনি কি স্থূল বা আপনার কি ওজন বেশি? আপনার মানসিক চাপ কি প্রচণ্ড?
জানতে হবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণঃ
* বেশির ভাগ সময় হার্ট অ্যাটাকে বুকের মধ্যে চাপ বোধ হয়, যা কয়েক মিনিটের বেশি সময় ধরে থাকে। ব্যথাটা মাঝেমধ্যে চলে যায়, আবার ফিরে আসে। একটা অস্বস্তিকর চাপ ও ঝাঁকুনি অনুভূত হয়।
* অনেক সময় বাহু, পিঠ, ঘাড়, চোয়াল অথবা পাকস্থলীতেও অস্বস্তি অনুভূত হয়।
* অনেক সময় বুকে অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস ছোট হয়ে আসে।
* অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে ঘাম দিয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব বা হালকা মাথাব্যথা, পিঠে বা চোয়ালে ব্যথা হতে পারে।
হাসপাতালে আসতে হবে গোল্ডেন আওয়ারে
কারও হার্ট অ্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের পর প্রথম এক ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার, অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসকের জরুরি চিকিৎসা নিতে পারলে রোগীর প্রাণ রক্ষা প্রায় নিশ্চিত করা সম্ভব।
যেভাবে বুঝবেন হার্ট অ্যাটাক এর কারনে, না গ্যাসের কারণে বুকব্যথা?
এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে অনেক সময় চলে যায়। বুকে ব্যথা চরমে উঠলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। রোগীর জীবনসংশয় দেখা দেয়। তারপরও চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেন। যদি হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা কম হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো প্রাণ রক্ষা পায়। কিন্তু বাকি জীবন কষ্ট করে চলতে হয়। কারণ, হার্ট অ্যাটাকের ফলে হৃৎপিণ্ডের কিছু অংশ অকেজো হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম ঝুঁকিতে পড়তে হয়। তাই একটু বেশি বয়সীরা বা যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের বুকে ব্যথা হলে অবহেলা না করে অন্তত একটা ইসিজি করে দেখতে পারেন যে হার্টের ব্যথা নয় তো?
ডায়াবেটিস থেকে হৃদ্রোগে আক্রান্তঃ
অধিকাংশ ডায়াবেটিসের রোগী হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েই অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগ—এ দুটি পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে বিষয়গুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত, যেমন অতি ওজন, ধূমপান, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা বংশগতি, এগুলো হৃদ্রোগেরও ঝুঁকি। তাই এ দুটি সমস্যা পরস্পরের হাত ধরেই চলে। একটির ঝুঁকি কমালে অপরটির ঝুঁকিও কমে আসে।
হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে যা করবেনঃ
* রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
* রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। রক্তে চর্বির মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করুন ও প্রয়োজনে চর্বি কমানোর ওষুধ গ্রহণ করুন।
* উচ্চ ক্যালরি ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত লবণও এড়িয়ে চলুন। ধূমপান করবেন না। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
* সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটুন বা যেকোনো ব্যায়াম করুন। কায়িক পরিশ্রম বাড়ান। ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। বিশেষ করে পেটের চর্বি কমানোর চেষ্টা করুন।
* নিয়মিত রক্তচাপ, শর্করা পরীক্ষা করুন, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন ও হৃদ্রোগ আছে কি না, তা নির্ণয়ে সচেতন হোন। সব সময় যে উপসর্গ থাকবে, এমন কোনো কথা নেই।
ভালো অভ্যাসে সুস্থ হৃদ্যন্ত্রঃ
ছোট্ট কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন জীবনটাকে বদলে দিতে পারে। সুস্থ রাখতে পারে শরীরের হৃদ্যন্ত্রকে। এর জন্য কিছু অভ্যাস ছাড়তে হবে, আবার কিছু সাদরে গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও খাদ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া। ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে বড় প্রয়োজন প্রতিজ্ঞা। সঠিক-স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম—এসব অভ্যাস নিজের পাশাপাশি সন্তান ও পরিজনদের মধ্যেও গড়ে তুলতে হবে।